Uncategorized

আব্বা আর আমি

খুব বৃষ্টি আসলে আমার খুব মন কেমন করে, মনে হয় আমার আব্বার কবরের মাটিটা ভিজে যাচ্ছে,খুব বেশী ভিজে গেলো কী? ভেজা মাটির একটা সোদা গন্ধ নাকে এসে লাগে, অসহ‍্য একটা অনুভুতি হয় আমার।

আমার আব্বা খুব গরমে ছাড়া টানা বৃষ্টি, গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পছন্দ করতেননা, যেহেতু নিয়মিত অফিস আবার বাইরে ডিউটি থাকতো ভিজে যেতেন তবে হ‍্যা আব্বার ঠান্ডা খুব কম লাগতো, মাঝেসাঝে গলা ব‍্যাথা হোতো, আমারো একটু এদিক সেদিক হলেই গলাটা আগে ধরে, ব‍্যাথায় ঢোক গিলতে কস্ট হলে আব্বাকে মনে পড়ে যায়।আব্বা গ্রামে যাওয়ার পর মোটামুটি বৃষ্টি হলে মসজিদে যেতেন কিন্তু বেশী হলে কাঁচা রাস্তায় কাদা হোতো খুব,হাটুর ব‍্যাথা নিয়ে অন্ধকারে আব্বা যেতেননা বাড়িতে নামাজ পড়তেন, রাস্তাটা আব্বার মৃত‍্যুর কিছুদিনের মধ‍্যে পাকা হয়ে গেছে, মুসুল্লীদের কস্ট কমে গেছে এখন।আব্বা থাকলে খুশী হতেন খুব।

ভাইয়ারা কবরস্থানে অনেক ফুল গাছ লাগিয়েছে আব্বার কবরে,গেটের পাশে, সারা কবরস্থানের মাটিতে দুবলা লাগিয়েছে যাতে বৃষ্টিতে মাটি ধুয়ে না যায়।ভাইয়ারাতো চাকরীতে বাড়িতে কেউ থাকেনা,গাছগুলোতে পানি দেওয়ার কেউ নেই,গাছগুলো কি বেঁচে আছে? তাতে সবুজ পাতার ফাঁকে ফুল এসেছে কি? আমার খুব ইচ্ছা অনেক ফুল ফুটুক সেই ফুলের ঘ্রাণ সারা কবরস্থানে ছড়িয়ে থাকুক,আমার আব্বা যে খুব আতরের সুঘ্রাণ পছন্দ করতেন, স্নিগ্ধ হালকা সুগন্ধ তাকে ছুয়ে থাকুক,তিনিতো সেখানেই ঘুমিয়ে আছেন।আচ্ছা কি কি ফুলগাছ লাগানো হয়েছে সেখানে? নিশ্চয়ই আল্লাহ্পাক আমার আব্বার কবরকে বেসেশতের ফুল দিয়ে সাজিয়ে রেখেছেন সুন্দর করে, এতো মানুষের দোয়া কি তিনি কবুল করবেননা?

আমি আম্মাকে না জানিয়ে একবার কবরস্থানে গিয়েছিলাম,গেটে তালা ছিলো আমার আব্বার কবর গেটের পাশে ডানদিকে দূর থেকে দেখেছি, কী ভীষণ কস্ট হয়েছিলো আমার, আসতে ইচ্ছা করছিলোনা, বাড়ি থেকে অনেকটা পথ কবরস্থান হেঁটে যেতে আমার খুবই কস্ট হয় তবু গিয়েছিলাম মনে হচ্ছিলো ওখানেই থাকি আরো কিছুক্ষণ।থাকি কাছাকাছি আব্বা নিশ্চয়ই টের পাচ্ছেন আমি গেটের গ্রীল ধরে ঐদিকে তাকিয়ে আছি।

তারপর আর কখনো যাইনি,ওখানে মেয়েদের কবরস্থানে যাওয়া নিষেধ।বাড়ি গেলে গ্রামের রাস্তায় যেতে,বড়চাচার জমিতে দাড়ালে দূর থেকে দেখা যায়, মনের ভেতর খচখচ করে একটা চাপা ব‍্যাথা বুকের ভেতরটায় ছড়িয়ে যায়।কবরস্থানে অনেক গাছ জায়গাটা ঠান্ডা আব্বার নিশ্চয়ই পছন্দ হয়েছে, তিনিতো সারাজীবন গ্রামে তার মায়ের কাছে ফিরতে চেয়েছিলেন।

বিয়ের পর থেকে আমি কখনো কখনো লিখতাম নিজের পরিবার নিয়ে,কিন্তু আব্বা আম্মা বাড়ি যাওয়ার পর থেকে আরো বেশী করে তাদের ফিল করতাম,কত স্মৃতি মনে আসতো আস্তে আস্তে নিজের মতো লিখতাম সমস্তটাই নিজের অনুভূতি,স্মৃতি আর প্রিয়মানুষদের থেকে হঠাৎ করে দূরে চলে যাওয়ার গোপন ব‍্যাথা, যেটা আমি আর দশজনের মতো গোপন রাখতে চাইনি,তবুতো সত‍্যি কত কত অনুভূতি আর ভালোবাসার আদরগুলো কখনোই লিখে বোঝানো সম্ভব নয়,আমার মতো করে আমার ব‍্যাথাটা সত‍্যিই কেউ বুঝতে পারবেনা।

অনেকের কাছেই বাড়াবাড়ি লাগতো,আদিখ‍্যেতা মনে হোতো, কিন্তু আমার কখনো মনে হয়নি,আমার লিখলে হালকা লাগতো, খানিকটা কান্নার পর মাথাটা পরিষ্কার হোতো।

শেষের দিকে আমার অসুখটা ধরা পড়ার দুতিনদিনপর আব্বাকে জানিয়েছিলাম,আব্বা চলে যাওয়ার ঠিক আগে দু সপ্তাহ মতো হবে ফোন দিলে খুব চুপচাপ থাকতেন,কান্নাকাটি করতেন,আমাকে দেখতে যেতে চাইতেন, তখন এরকম যখন ইচ্ছা বাড়িতে যেতামনা আমি,সাড়ে চারমাস হয়েছিলো আমি ভেবেছিলাম আর কিছুদিন হোক তারপর যাবো,বাড়িতে যাওয়া আর বেশীদিন থাকা নিয়ে কথা শুনতে আমার ইচ্ছা হোতোনা, সংসারের জটিলতায় আবদ্ধ থেকে আব্বার কাছে যেতে দেরী করছিলাম,আমার খুব অস্থির লাগতো,আব্বার জন‍্য মন কেমন করতো,একটা হারিয়ে ফেলার শঙ্কা গ্রাশ করেছিলো আমাকে।মনটা সারাক্ষণ বলতো খারাপ কিছু হবে খুব খারাপ।কিন্তু সত‍্যিই যে হারিয়ে ফেলছি বুঝে উঠতে না উঠতেই সব শেষ হয়েছিলো।এতোটাও খারাপ কি হতেই হোতো?

কত দীর্ঘদিন আমার আব্বাকে আমি দেখতে পাইনি,কত কত কথা আমাদের বলা হয়নি, শেষদেখার সেই স্মৃতি আমার কাছে এখনো ধ্বংসস্তুপে দাড়িয়ে থাকার মতো, আমার শুধুই মনে হয়েছিলো আমি সব হারিয়ে ফেলেছি সত‍্যিইতো কোথাও কেউ নেই, আব্বার খাটিয়ার কাছে যেয়ে আমি বসে পড়েছিলাম, কান্নারত বিলাপের মধ‍্যেও আমার এখনো মনে আছে, সবাই যখন আমাকে থামাতে এসেছে ,আমার আম্মাকে আমি তখনো দেখিনি আম্মা আর দাদী এক জায়গায় অজ্ঞানের মতো পড়ে আছেন, সবাই যখন সান্তনা দিচ্ছে,ছোটভাইয়া বলছে,” থাক ওকে বলতে দিন ও একটু বলুক কান্নাকাটি করুক বুকটা হালকা হবে,” না কিছুই হালকা হয়না, কোনো ব‍্যাথাই সয়ে যায়না দিনে দিনে ব‍্যাথা আরো গভীর হয়,আমার যে আব্বাকে ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করে।

আব্বার মৃত‍্যুতে আমার বুকে একটা পাথর এসে চাপা দিয়ে আছে, খুব ভারী তা আর কখনো নামবেনা হালকা হবেনা, তিনি যে আমার সাথে দেখা করতে চেয়েছিলেন,কিন্তু আমাদের দেখা হয়নি এই ব‍্যাথা এই অপরাধবোধ আমাকে খুব কস্ট দেয়। আমি আব্বাকে দুচোখ বন্ধ করে অনুভব করতে চাই, সব কস্টের সময়গুলোতে, সব আনন্দের মাঝখানে, জীবনের প্রতিটা মুহূর্তে তাকে পাশে চাই সেটাতো আর কখনোই হওয়ার নয়, এই জীবনের এই পথচলাতে আব্বা এতো তাড়াতাড়ি আমাকে এরকম একা করে দেবেন এটাইবা কে জানতো?

আমার আব্বা আমার উদ‍্যোগের একজন বড় সাপোর্টার ছিলেন তার দেওয়া হাত খরচের থেকে জমানো টাকা দিয়েই আমি আমার শখের কারুকাজ কে শুরু করেছিলাম,দুই একবার তার থেকে ধারো নিয়েছি। সিরাজগঞ্জ থেকে প্রচুর তাঁতপণ‍্য তিনি আমাকে কুরিয়ার করেছেন এই বর্ষা আর বন‍্যার পানি ডিঙ্গিয়ে।

আমার খুব শখ ছিলো আব্বাকে হাতের কাজের পাঞ্জাবী করে দেওয়ার,কিন্তু আব্বা থাকতে আমার উদ‍্যোগে তখনো হাতের কাজের পাঞ্জাবী আসেনি।একটা সুক্ষ্ম ব‍্যাথাবোধ নানা সময়েই অনেক কাজের ভীড়ে মনে আসে। যখন কোনো আপুরা তাদের বাবা,স্বামী বা ভাইয়ের জন‍্য পাঞ্জাবী অর্ডার করেন আমি আমার আব্বাকে তখন খুব মিস করি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site is protected by reCAPTCHA and the Google Privacy Policy and Terms of Service apply.